তোপূর্বে আমরা সমাজবিজ্ঞানের থিওরেটিকাল পারস্পেক্টিভ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। যার প্রথম পর্ব হিসাবে ফাংশনালিস্ট থিওরি বা পারস্পেক্টিভ আমরা আলোচনা করেছি। বর্তমানের লেখায় আমরা আরেকটি থিওরেটিকাল পারস্পেক্টিভ নিয়ে আলোচনা করবো যা সমাজবিজ্ঞানে এক নতুন আঙ্গিক এনে দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানে যার নাম কনফ্লিক্ট থিওরি, আমরা বাংলায় যাকে সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব তত্ত্ব বলে তরজমা করবো। চলুন শুরু করা করা যাক কাকে বলে কনফ্লিক্ট থিওরি এবং কিভাবে সমাজবিজ্ঞানে এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
২
আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে সংঘর্ষ তত্ত্বের আবির্ভাব মূলত মহতী কার্ল মার্ক্সের চিন্তা এবং লেখনী দ্বারা অনুপ্রাণিত, যিনি সামাজিক শ্রেণী সংঘর্ষকে দেখেছেন সমাজের প্রধান চালিকা শক্তি বা ইঞ্জিন হিসাবে এবং তিনি এই নিরন্তর সংগ্রাম বা প্রতিযোগিতাকে দেখেছেন সমাজ বা সামাজিক পরিবর্তনের প্রধান ফোয়ারা হিসাবে।
পশ্চিমা রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তায় মার্ক্সীয় চিন্তার প্রভাব তখন থেকে শুরু হলেও আমেরিকাতে গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত মার্ক্সের এই তত্ত্বকে তেমনভাবে বিবেচনা করা হত না বা একরকম অবহেলায় করা হত। আমেরিকাজুড়ে ষাটের দশকের সামাজিক ও রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থাকে তখন ফাংশনালিস্ট থিওরি নয়, বরঞ্চ মার্ক্সের সংঘর্ষ তত্ত্ব দ্বারাই খুব সহজে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছিল। মূলত তখন থেকেই খোদ আমেরিকাতেও এই তত্ত্বের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আধুনিক সংঘর্ষ তত্ত্ব মার্ক্সের শুধু সামাজিক শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্বেই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই, অধিকন্তু এই তত্ত্বকে পরবর্তীতে রাইট মিলস এবং লুইস কজার তাদের লেখা দ্বারা আরো শাণিত করেছেন, যা সামাজিক শ্রেণীর গণ্ডি পেরিয়ে সংঘর্ষকে আবিষ্কার করেছে যেকোন সমাজে বিদ্যমান বাস্তবতা হিসাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং স্বার্থের মাঝে। সমাজে এই দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে নবীন ও প্রবীনের মাঝে, উৎপাদক এবং ভোক্তার মাঝে, কিংবা শহুরে ও গ্রাম্যের মাঝে এবং এক বর্ণ বা জাতির সাথে অপর বর্ণ এবং জাতির মাঝে।
৩
সংঘর্ষ মতবাদীরা প্রথমেই ফাংশনালিস্ট বা ক্রিয়াবাদী চিন্তাবিদদের থেকে নিজেদের আলাদা করেন এই ভিত্তিতে যে, সমাজ হরহামেশা একটা পরিবর্তনের মধ্যে থাকে, যেখানে সংঘর্ষ সমাজের একটি স্থায়ী এবং অনিবার্য বাস্তবতা। তবে এই সংঘর্ষ মানেই যে খুল্লামখুল্লা মারামারি-হানাহানি তা নয়। এই সংঘর্ষ মূলত বিভিন্ন লক্ষ্য, উদ্দেশ্যর ব্যাপারে উত্তেজনা, বৈরীভাব ও শত্রুতা, প্রতিযোগিতা এবং অনৈক্য ও গরমিল। এই দ্বন্দ্ব কোন দৈবাৎ ঘটনা নয় যা সমাজের ধারাবাহিক এবং স্বাচ্ছন্দময় ক্রিয়াকে বিনষ্ট করে, বরঞ্চ এটা একটা নিত্য প্রক্রিয়া এবং সমাজ জীবনের এক অবিভেদ্য অংশ। মানুষের আকাঙ্ক্ষিত বিষয়াদি, যেমন; ক্ষমতা, সম্পদ এবং মর্যাদা হামেশায় অপ্রতুল এবং এসবের প্রতি তার চাহিদা সর্বদাই তার যোগানকে ছাড়িয়ে যায়।
যারা এসবের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে তারা অন্যকে ঠুকে দিয়ে নিজের কায়েমি স্বার্থকে মজবুত করে। আর তাই সমাজ চালনের ব্যাপারে ক্রিয়াবাদী মতবাদীদের সাধারণ ঐক্যমতকে সংঘর্ষ মতবাদীরা কল্পিত বলে আখ্যায়িত করেন। তারা বলেন বাস্তবে যা ঘটে তা হচ্ছে, ক্ষমতাবান সর্বদা জোরপূর্বক অন্যের থেকে বশ্যতা এবং সম্মতি আদায় করে নেয়।
অন্যদিকে সংঘর্ষ মতবাদীরা দ্বন্দ্বকে নেহাৎ ধ্বংসাত্মক বলেও মনে করেন না, যদিও এর সম্ভাব্যতাকে তারা উড়িয়েও দেন না। তাদের দাবী হল, দ্বন্দ্ব প্রায়ই ইতিবাচক প্রভাব টেনে আনে। এটা সমাজের বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীকে একত্র করে এবং সেই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাবলী সকলের দৃষ্টিগোচর করে এবং হিতকর পরিবর্তন নিয়ে আসে যা হয়ত অন্যথায় সম্ভব হতো না। এই দিক থেকেই বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠে। সামাজিক সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্বের মাধ্যমে আনীত সেই পরিবর্তন সমাজকে বড় ধরনের অস্থিরতা থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
৪
স্বাভাবিক ভাবেই এখন প্রশ্ন আসে যে, সমাজের এই ধরনের গঠনের সাথে কাদের স্বার্থ জড়িত এবং কারা এই কাঠামো থেকে উপকৃত হয় আর কারাই বা বঞ্চিত হয়? উদাহরণস্বরূপ সমাজে বিদ্যমান অসাম্যের ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসীদের মতামত হল, সমাজে প্রভেদ টিকে রয়েছে এই জন্য নয় যে তা সমাজ পরিচালনের জন্য আবশ্যকীয়; বরঞ্চ এই জন্যে যে, সমাজের কিছু মানুষ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে এবং তারাই এই সুবিধাকে তাদের উত্তরপুরূষের জন্য রেখে যেতে পেরেছে। একই ভাবে তারা “পরিবেশ দূষণকে” শিল্পব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন না, বরং তারা একে কিছু ক্ষমতাবান কর্পোরেট স্বার্থবাদীদের কাজ বলে বিবেচনা করেন যারা পরিবেশ দূষণকারী ম্যানুফ্যাকচারিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পয়সা হাতিয়ে নেন। একই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বাজারে হরেক রকম সিগারেট এবং তামাক দ্রব্যের বিস্তারকে ব্যাখ্যা করতে পারি যা একদমই বাস্তবসম্মত এবং সর্বজনস্বীকৃত। কিছু ক্ষমতাধর বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিজেদের মুনাফার স্বার্থে মানুষকে চরম অবনতির দিকে ঠেলে দেয়া তামাক বাজারজাতকরণ এবং ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছে। ক্ষতির দিক বিবেচনায় যা নির্দ্বিধায় নিষেধাজ্ঞার শামিল।
আধুনিক সমাজ ব্যাপক মাত্রায় পেশা, মতবাদ জীবন-ধরন এবং সামাজিক গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। সেখানে সমাজের যেকোন বিষয়েই কিছু মানুষ থাকে যারা লাভবান হয় আর কিছু মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আর যেখানে দ্বন্দ্বের ফলাফল সব সময় শক্তিমান এবং বলবানের পক্ষেই আসে সেখানে এই স্বার্থের দ্বন্দ্বকে ব্যাতিরেকে সামাজিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।
সংঘর্ষ তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল সমাজের বিভিন্ন আঙ্গিক এবং পরিপেক্ষিতকে তুলে ধরা যা ফাংশনালিস্ট বা ক্রিয়াবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজের স্থিতিস্থাপকতা এবং সাধারণের ঐক্যমতের উপর গুরত্ত্ব দিয়ে সেগুলোকে উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু একদিকে এটাই আবার দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির দূর্বলতাও বটে। কেননা, খুব তীক্ষ্মভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিবর্তনের উপর নজর নিবিষ্ট করে তারা খুব সংহত, স্থিতিশীল এবং সমাজ জীবনের অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে বিতর্কিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে।
৫
তথাপি আমাদের বর্তমান সমাজ কিংবা যেকোন সমাজের বৈশিষ্ট্যকে বোঝার জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মূল্যবোধ এবং স্বার্থের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত রাখতে হবে। তাদের প্রকৃতি, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকে আমরা তাদের মূল্যবোধ, আদর্শ এবং স্বার্থ দ্বারাই চিহ্নিত করতে পারবো। কেননা স্বার্থোদ্ধারের মাঝেই ব্যক্তিচরিত্র ফুটে উঠে।
আসলেই এটা অনেক কাজে দিচ্ছে পড়াশোনার জন্য��
ReplyDelete