ক্রিয়াবাদ দৃষ্টিভঙ্গি(Functionalist Perspective)


শুধুমাত্র তত্ত্বই (Theory) আমাদের সামাজিক জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে বোধগম্য করে তোলে। মূলত এই তত্ত্বই আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন বলে প্রতীয়মান যে কোন বিষয়কে ব্যাখ্যা করা কিংবা পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য একটি সরলীকৃত কাঠামোতে দাড় করে তার হেতু এবং ফল সম্পর্কে আমাদেরকে ওয়াকিবহাল করে।
সামাজিক তত্ত্বগুলোও (Social Theorie)বিভিন্ন বিষয়ের উদ্দেশ্য এবং যুক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকে।
সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbeart Spencer),কার্ল মার্ক্স (Karl Marx), এমিলি দুর্খেইম (Emile Durkheim) এবং ম্যাক্স বেবার (Max Weber)বিভিন্ন সামাজিক তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন। যদিও পরবর্তী সময়ের সমাজবিজ্ঞানীগণ একে দেখেছেন সংকীর্ণ ও সীমিত তত্ত্ব দ্বারা সমাজের প্রধান সমস্যাগুলোকে ব্যাখ্যার চেষ্টা হিসেবে। 
তথাপি সমাজ (Society)এবং সামাজিক আচার-ব্যবহারকে (Social Behaviour) ব্যাখ্যা করার জন্য অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (Theoretical Perspectives) দ্বারা পরিচালিত হন যা তাদেরকে সমাজের কোন স্পেসিফিক বা নির্দিষ্ট সমস্যা সম্পর্কে একটি দৃষ্টিভঙ্গি (Point of View) এবং নির্দেশনা প্রদান করে।
আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে প্রধানত তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি (Theoretical Perspectives) পাওয়া যায়। তা হলো ক্রিয়াবাদ বা কার্যকারিতা দৃষ্টিকোণ (Funtionalist), সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব (Conflict) এবং মিথস্ক্রিয়াবাদী (Interactionist)দৃষ্টিকোন বা দৃষ্টিভঙ্গি।
আজকের এই রচনায় ক্রিয়াবাদ বা কার্যকারিতা (Functionalist) দৃষ্টিকোন নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ক্রিয়াবাদ দৃষ্টিকোণটি মূলত হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Soencer) এবং এমিলি দুর্খেইম (Emile Durkheim)এর অবদান। স্পেন্সার (Spencer) সমাজকে একটি জীবিত বা প্রাণবন্ত দেহ (Living Organism) হিসেবে দেখছেন। আর আমরা জানি যে, প্রত্যেকটি দেহেরই পরস্পরসম্পৃক্ত অঙ্গ দ্বারা গঠিত একটি কাঠামো রয়েছে। আর সেই দেহের জীবনধারণে প্রত্যেকটি অঙ্গেরই কোন না কোন নির্দিষ্ট ফাংশন বা কাজ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা মানবদেহের কথা ভাবতে পারি যার মাথা থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ড,যকৃত কিংবা পা, প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়া রয়েছে।
স্পেন্সারের (Soencer) মতে,সমাজ হলো এমনই পরস্পরসম্পৃক্ত বেশকিছু অঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি কাঠামো (Structure)। সমাজের অপরিহার্য অংশ হলো পরিবার,ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা (Ovrall Stability) বজায় রাখতে এই অঙ্গগুলো বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। আধুনিক ক্রিয়াবাদ যদিও সমাজকে প্রানবন্ত কোন জীবসত্তা হিসেবে বিবেচনা করে না তথাপি তারা সমাজকে পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত অঙ্গ হিসেবেই ধারন করে। আধুনিক ক্রিয়াবাদ মূলত ট্যালকট পারসন (Talcott Parson) এবং রবার্ট মের্টনের (Robert Merton) লেখনী দ্বারা প্রভাবিত।
ক্রিয়াবাদ সমাজকে দেখে একটি সুসংগঠিত (Organized),স্থিতিশীল (Stable) এবং সুসংহত (Well-integrated) ব্যবস্থা হিসেবে যার সদস্যগণ মৌলিক মূল্যবোধের (Basic Values) ব্যাপারে একমত পোষণ করে।
স্বাভাবিক অবস্থাতে সমাজের প্রত্যেকটি অঙ্গ বা উপাদান, যেমন স্কুল,পরিবার অথবা রাষ্ট্র সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকে রক্ষা করে একে অপরের জন্য মানানসই বা যুগপৎ হয়ে থাকে। যেমন,পরিবার সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ যা মানুষের জৈবিক আচরণকে (Sexual Behaviour) নিয়ন্ত্রিত করে,সন্তানদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধ (Social Values) সঞ্চার করে এবং পরিবারের অল্পবয়স্ক এবং বর্ষীয়ান সদস্যদের দেখভাল করে।
সুতরাং, ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিতে মৌলিকভাবেই সমাজ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে। ফলে দ্রুততর কোন সামাজিক পরিবর্তন তার সংহতিকে বিনাশ করে। কেননা, সমাজের কোন একটি অংশের পরিবর্তন অপর কোন অংশকে পরিবর্তিত হতে প্রভাবিত করে। উদাহরনস্বরুপ, কোন দেশের অর্থনীতিতে যদি অধিক পরিমানে জনশক্তির প্রয়োজন হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো তা সরবরাহের ব্যবস্থা করে এবং রাষ্ট্রও শিক্ষা খাতে অধিক পরিমানে বাজেট বরাদ্দ করে। কিন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে যখন সমাজের অন্যান্য অংশগুলোও সঙ্গতি না রাখতে পারে তখন সামাজিক অসাম্য তৈরী হয়।
এ পর্যায়ে এসে একটি প্রশ্ন দাঁড়ায়, তা হলো সমাজের কোন অঙ্গের কি কাজ তা বোঝা যাবে কিভাবে?
কখনো কখনো সামাজিক অঙ্গগুলো তার থেকে প্রত্যাশিত ফাংশন বা ক্রিয়ার বাইরেও কিছু ফলাফল ডেকে আনে। সে লক্ষেই রবার্ট মের্টন (Robert Merton) ফাংশন বা কাজকে দুইভাগে ভাগ করেছেন।
প্রথমত, সুস্পষ্ট কাজ (Manifest Functions) বা যা সমাজের কোন অংশের নির্দিষ্ট এবং প্রত্যাশিত কাজ বা ক্রিয়া।
দ্বিতীয়ত, সুপ্ত কাজ (Latent Functions) বা যা তার প্রত্যাশার বাইরে এবং স্বাভাবিক প্রদায়ক নয়।
যেমন একটি কল্যান রাষ্ট্রের ম্যানিফেস্ট ফাংশন বা প্রত্যাশিত কর্তব্য হলো তার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উপবাস বা অনাহার থেকে বাঁচানো। কিন্তু তার সুপ্ত কাজ (Latent Functions) হলো যে কোন রকমের নৈরাজ্যকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থাকে প্রতিহত করা যা লক্ষাধিক মানুষকে ইনকাম সোর্স বা অর্থের উৎস থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
মের্টন (Merton) আরো ব্যাখ্যা করেছেন যে, সমাজের প্রত্যেকটি অংশই সব সময় কার্যকর হয় না। অধিকন্তু ক্ষেত্রবিশেষে কোন সামাজিক অঙ্গ সামাজিক স্থিতাবস্থাকে বিনষ্ট করে এবং অকার্যকর (Dysfunctional) হয়ে পড়ে। যেমন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উচ্চ জন্মহার (Hight Birth Rates) অত্যন্ত অকার্যকর একটি অবস্থা, কেননা তা অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
আবার ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের কোন অংশের ক্রিয়ার নতিজা একই সাথে কার্যকরী (Functional) এবং অকার্যকরী (Dysfunctional) দুইই হয়ে থাকে। যেমন, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এরকম বহু পন্য রয়েছে যার উপর আমরা অত্যন্ত নির্ভরশীল ( অর্থাৎ তা প্রত্যাশিত এবং কার্যকরী (Manifest Function) পাশাপাশি তা আবার প্রতিবেশ দূষণেও মূখ্য ভূমিকা রেখে থাকে। সুতরাং সামাজিক ব্যবস্থায় কোন অংশের পূর্ণ প্রয়োগের পূর্বে তার সম্পর্কে সতর্কভাবে ভাবা উচিত।
সে জন্যই প্রায়শই ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন যে কোন সমাজবিজ্ঞানীকেই কোন উপাদান ব্যবহারের পরিনাম কি হবে এবং তা ভবিষৎে ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়।
ক্রিয়াবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে কোন উপাদান বা  অঙ্গের বিভিন্ন লোকশান থাকা সত্ত্বেও তার অস্তিত্ব কেনো টিকে আছে তা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে উপযোগী।
আর ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিকোণের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো তার রক্ষনশীল মনভাব (Attitudes)। যেহেতু তার প্রধান গুরুত্বের ক্ষেত্র হলো সামাজিক শৃঙ্খলা এবং তার স্থিতাবস্থা।

Comments

Post a Comment