ফরাসি বিপ্লব A to Z (French Revolution)

১.
সমগ্র মানব সমাজের ইতিহাসেই ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) এনেছিলো খুব বড়ো এক পরিবর্তন।এই বিপ্লব শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের বিপ্লব ছিলো না,এ বিপ্লব ছিলো রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তনের বিপ্লব।এই বিপ্লব ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এমন এক কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসে পরবর্তীতে যার প্রভাব ছিলো অপরিসীম।জাতীয়তাবাদ এবং পুঁজিবাদ জায়গা করে নিলো পুরোনো সামন্তবাদী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে হটিয়ে।’নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ,সামন্ত অর্থনীতি থেকে বুর্জোয়া অর্থনীতিতে প্রবেশ,অভিজাততন্ত্রের উচ্ছেদের মাধ্যমে নাগরিকত্বের যুগে পদার্পন,রাষ্ট্রের উপর থেকে চার্চের কর্তৃত্বের অবসান-এই হচ্ছে ফরাসি বিপ্লবের ফল,যা মানুষের জন্য তৈরি করেছিলো এক নতুন নৈতিক জগতের(New Moral Universe)’(কার্ল মার্কস)।যেখানে মানুষ নিজেই হয়ে উঠছে নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা,রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আইনের শাসন দ্বারা,ঘোষিত হচ্ছে মানুষের সমান অধিকারের বাণী। [Declaration of the rights of Man and Citizens of 1789]

২।
কিন্তু কেন শুরু হয়েছিলো ফরাসি বিপ্লব?
এডমন্ড বার্ক এই বিপ্লবের জন্য দায়ী করেছিলেন এনলাইটেনমেন্ট যুগের ফরাসি দার্শনিকদের;বিশেষ করে রুশোকে। তিনি মনে করতেন রুশোই ফরাসিদের মধ্যে প্রথম একটা চেতনা ঢুকিয়ে দিলেন:জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের শাসনের ধারণা।
বার্কের মন্তব্যের গুরুত্ব অস্বীকার করার কিছু নেই। রাজা ষোড়শ লুইয়ের স্বেচ্ছাচারী দীর্ঘ রাজতান্ত্রিক শাসন,অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান অবনতি আর প্রথম ও দ্বিতীয় এস্টেটস(যাদের বেশিরভাগই ছিলো সামন্ত ও যাজক শ্রেণী) জেনারেলদের শাসনের ব্যর্থতা এবং তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ফরাসি জনগণকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তোলে। এর থেকে মুক্তির উপায় ফরাসি জনগণ দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজছিল;আর সে পথটা দেখালেন রুশো;বললেন ‘জনগণের শাসন’এর কথা,জেনারেল উইলের কথা,পরবর্তীতে বিপ্লবের সময় বিপ্লবের অন্যতম নায়ক রবেস্পিয়ার(Robespierre) যাকে হুবহু উদ্ধৃতি করতেন।

৩।
ফরাসি বিপ্লবকে তিনটা পর্যায়ে ভাগ করা হয়।প্রথম পর্যায় শুরু হয় ১৭৮৯ এর ১৭ই জুন তৃতীয় এস্টেটস এর সদস্যদের (যাদের বেশিরভাগই ছিলো বুর্জোয়া এবং পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর মানুষ) প্রথম এস্টেটসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং জাতীয় পরিষদ(National Assembly) গঠনের মাধ্যমে। ১৭৮৯ এর আগে ফরাসি সমাজ শাসিত হতো বড়ো বড়ো সামন্ত এবং যাজকদের দ্বারা,যারা মূলত ছিলো প্রথম এস্টেটস এবং দ্বিতীয় এস্টেটস এর সদস্য। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ (বুর্জোয়া,পেটি-বুর্জোয়া,প্রলেতারিয়েত) যারা সমগ্র জনগণের তিন-চতুর্থাংশ এই সামন্ত-যাজকদের শাসনে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে;বিশেষ করে ছোট ছোট বুর্জোয়ারা যারা দীর্ঘদিন ধরেই সামন্তদের উপর ছিলো ক্ষিপ্ত অবস্থায়। তাদের উন্নতির পথে সামন্তরা ছিলো মস্ত বাঁধা। সামন্তবাদ উচ্ছেদ ব্যতীত তাদের আর কোন পথ ছিলো না। এরই প্রেক্ষিতে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফরাসি জনতা বাস্তিল দূর্গ আক্রমণ করে বসে;যেটা ছিলো সামন্তবাদী সমাজের নিপীড়নের এক বড়ো প্রতীক। বাস্তিল দূর্গ পতনের পরই এটা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে ফরাসি সমাজ আর রাজা এবং সামন্তদের শাসনে চলতে পারবে না। ফরাসি জনগণকেই হাতে তুলে নিতে হবে ক্ষমতা।

১৭৯২ সালে ম্যাক্সিমিলিয়েন রবেস্পিয়ার বিপ্লবের নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন। শুরু হয় বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়।তিনি ছিলেন ন্যাশনাল এসেম্বলিতে জ্যাকোবিনদের বিপ্লবী নেতা। রবেস্পিয়ারের শাসনকালকে(১৭৯২-৯৪) বলা হয় Reign of Terror বা ত্রাসের রাজত্ব।এই সময়কালে রবেস্পিয়ার রাজা ষোড়শ লুই সহ হাজার হাজার সামন্তদের গিলোটিনে হত্যা করেন। বলতে কি রবেস্পিয়ার পুরোনো সমাজ ব্যবস্থার সমস্ত চিহ্নই ধ্বংস করতে ছিলো বদ্ধ পরিকর। আর এ কারনেই মার্কস মনে করেন,ত্রাসের রাজত্বে অজস্র রক্তপাত এবং ধ্বংসযজ্ঞ চললেও সেটা ছিলো ঐ সময়ের জন্য ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয়। কেননা পুরোনো সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ বিপ্লব এবং রক্তপাত ব্যতীত সম্ভব নয়।
ফরাসি বিপ্লবের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৭৯৪ সালে, রবেস্পিয়ারের পতন এবং ডিরেক্টরির (The Directory) শাসনের আরম্ভের মাধ্যমে ।ডিরেক্টরিও ছিলো একটি বিপ্লবী সরকার যা মূলত গঠিত হয় ৭ জন সদস্য(দুজন উপদেষ্টা এবং পাঁচজন নির্বাহী) নিয়ে। বিপ্লবের এই তৃতীয় এবং শেষ পর্যায় স্থায়ী হয় ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত;ডিরেক্টরির উচ্ছেদ এবং নেপোলিয়নের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে।

৪।
দশ বছরের বিপ্লবী সময়কালে ফ্রান্স কোন স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারে নি সত্য;রক্তপাত এবং বিশৃঙ্খলা ছিলো বিপ্লবের নিত্যসঙ্গী। বিপ্লবের পর নেপোলিয়নের মাধ্যমে ফরাসি সমাজ আবার একনায়কতন্ত্রের মধ্যে গিয়ে পড়ে। কিন্তু এসব ব্যাপার ফরাসি বিপ্লবের গুরুত্বকে এতোটুকুও খাটো করে না।বুর্জোয়ারা প্রলেতারিয়েতদের সঙ্গী করে যে কারনে এ বিপ্লব শুরু করেছিলো তা পুরোপুরি সফল হয়েছিলো ।ফরাসি সমাজ আর আগের সমাজ কাঠামোয় ফিরে যায় নি। দশ বছর সময়কালে সমাজের পুনর্গঠন এমনভাবে হয় যে সামন্তবাদের ধ্বংসাবশেষ ব্যতীত পুরাতন সমাজের কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।ফরাসি সমাজ প্রবেশ করে পুঁজিবাদী যুগে,শিল্প সমাজের যুগে: মানুষের ভাগ্য আর রাজা বা সামন্ত নিয়ন্ত্রণ করবে না,নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষ নিজেই। নিজের শ্রম,মেধা এবং পুঁজিকে লগ্নি করে।সে আর দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা থাকবে না কোন মনিবের উপর।
সাম্য,মৈত্র্য ও ভ্রাতৃত্বের বাণীকে সঙ্গী করে ফ্রান্স যে দৃষ্টান্ত গড়ে পরবর্তীতে তার প্রভাব হয়ে দাঁড়ায় ব্যাপক। একে একে ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রই সামন্তবাদী সমাজ উচ্ছেদ করে গঠন করে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। আর এ কারনেই হয়তো ফরাসি বিপ্লবের মতো এতো গুরুত্ববাহী বিপ্লব পৃথিবীতে আর হয়-ই নি!

Comments