আঠারো শতকে থমাস হবস পরবর্তী সময়ে যুক্তির মঞ্চে যার দর্শন সবাইকে আলোকিত করে তিনি হচ্ছেন জন লক। তার বিখ্যাত গ্রন্থ Two Treaties of the Government তৎকালীন সময়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। লক বিশ্বাস করতেন যে, প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন এবং ব্যক্তি হিসাবে তার রয়েছে বেশ কিছু অধিকার । যার ভিতর জীবন (Life) ধারণ, স্বাধীনতা (Liberty) এবং সম্পত্তির (Property) অধিকার প্রধানতম। আর এই বিশ্বাসের সমর্থনেই তিনি তার Two Treaties of Government লিখেছিলেন। অপরদিকে ধর্মীয় চেতনায় গড়ে উঠা চার্চের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং তৎকালীন সময়ে মানুষ ঈশ্বরপ্রদত্ত রাজতন্ত্রের গোলাম বলে যে যুক্তি ছিল তিনি তার বিরুদ্ধে সামাজিক চুক্তি মতবাদকে প্রয়োগ করেন। আর রাজনৈতিক সরকার ব্যবস্থার বৈধতার প্রমান হিসাবে সামাজিক চুক্তি মতবাদকে ব্যবহার করেন।
আমরা বিগত পর্বে সামাজিক চুক্তি সম্বন্ধে থমাস হবসের মতবাদ জেনেছি। সেখান থেকেই আমরা লকের সামাজিক চুক্তিবাদ শুরু করতে পারি। কারণ জন লকও তার পূর্ববর্তী দার্শনিক হবসের সাথে এই ব্যাপারে একমত যে, সামাজিক চুক্তি পূর্ববর্তী মানুষের অবস্থা যেহেতু প্রাকৃতিক এবং অরাজনৈতিক, সুতরাং সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে গঠিত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ মূলত একটি অপ্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। তবে হবস বর্ণিত প্রাকৃতিক রাজ্য থেকে লকের প্রাকৃতিক রাজ্যের ধারণাতে এক বিস্তর ফারাক বিরাজমান।
২
থমাস হবস প্রকৃতির রাজ্যকে বর্ণনা করেছেন একদম শৃঙ্খলাবিহীন এক অবস্থায় যেখানে মানুষ তার নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় সদা নিয়োজিত। কিন্তু জন লক হবসের এই ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তার মতে প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন ছিল তুলনামূলক ভালো এবং আনন্দদায়ক। এমন কি তিনি প্রাকৃতিক রাজ্যকে স্বর্ণ যুগ (Golden Age) বলেও উল্লেখ করেছেন।
জন লকের মতে, একজন মানুষ নিজের জীবন যেভাবে দেখতে চায় ঠিক তেমনই ছিল প্রকৃতির রাজ্য, যা ছিল স্বাধীনতায় ভরপুর এবং সম্পূর্ণ (Perfect) এক ব্যবস্থা যেখানে ব্যক্তিগত জীবনে অন্য কারো হস্তক্ষেপ ছিল না। যদিও প্রকৃতির রাজ্যে আইন লংঘনের জন্য জনগণকে শাস্তিদাতা কোন নাগরিক শাসক গোষ্ঠি বা সরকার ছিল না তথাপি প্রকৃতির রাজ্য নৈতিকতা-বিবর্জিত ছিল না। লকের ভাষ্য মতে, ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রকৃতিক আইন দ্বারা সেই সময়ের জীবন নিবিষ্ট ছিল এবং সেই প্রকৃতির আইনই ছিল সকল নৈতিকতার উৎস। ঈশ্বরের নিকট সকলে সমান হেতু প্রকৃতির আইন দ্বারাই অপরের অনিষ্ট করা নিষেধ ছিল। সুতরাং এসব অবস্থা বিবেচনায় লক প্রকৃতির রাজ্যকে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ বলে বিবেচিত করেছেন যেখানে রয়েছে অবাধ মুক্ত বা স্বাধীন অবস্থা (State of Liberty)। আর এখানেই লকের সাথে হবসের পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়।
৩
হবসের প্রকৃতির রাজ্যে রাজনৈতিক সরকারের আবির্ভাব এবং সামাজিক চুক্তির কারণ ছিল মূলত মানুষের স্বভাবজাত স্বার্থপর বৈশিষ্ট্য ( হবসের মতে) এবং সেই চেষ্টায় যুদ্ধ বা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি। কিন্তু লকের সামাজিক চুক্তিতে জন-সরকার (Civil Government) আবির্ভাবের পিছনে প্রধান ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিভাবে সম্পত্তির উদ্ভব হলো সেই যুক্তিও লক দিয়েছেন।
তার ভাষায়, মানুষ প্রকৃতির কাঁচামালের সাথে নিজের শ্রমকে যুক্ত করে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করেছে। উদাহরনস্বরুপ বলা যেতে পারে যে, একজন লোক কোন জমি আবাদ করে সেখানে কোন ফসল ফলালে সেই জমি এবং জমি থেকে উৎপাদিত ফসল উক্ত ব্যক্তির সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তবে এক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা ছিল। কোন ব্যক্তি নিজের ব্যবহারের অধিক সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে পারতো না এবং ন্যায্য প্রাপ্যের অধিক নিজের কাছে রাখতে পারতো না। এমন কি প্রকৃতির রাজ্যে লক মানুষের বৈবাহিক অবস্থার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি সেই সমাজকে বৈবাহিক সমাজ (Conjugal Society) বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেখানে পিতা-মাতা স্বেচ্ছায় সন্তান পালনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতেন (যাকে আমরা বিবাহ বলছি) এবং এই সমাজ ব্যবস্থা ছিল মূলত নৈতিক, রাজনৈতিক নয়। রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার আবির্ভাব হয় তখনই যখন সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চিতকরণে এবং প্রাকৃতিক আইন লঙঘনকারীর শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রকৃতির রাজ্যের প্রত্যেকই প্রকাশ্য সম্মতিতে (Consent) নিজেদের শাসনাধিকার কোন সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে একমত হল। অন্যভাবে বললে, প্রকৃতির রাজ্য ছেড়ে নতুন সমাজ গঠনের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে সরকারের অধীনে একটি রাজনৈতিক কাঠামোতে দাড় করাল বা সরকার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করল।
প্রাক-রাজনৈতিক থেকে রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তরের পর মানুষ নিজেদের মাঝে তিনটি প্রতিষ্ঠান কে খুঁজে পেল যার অভাব সে প্রকৃতির রাজ্যে অনুভব করেছে। যথা: আইন (Law), আইন অনুসারে মীমাংসাকারী বিচারক (Judges) এবং সেই আইনকে বাস্তবায়নে অবধারিত নির্বাহী ক্ষমতা (Executive Power। সুতরাং প্রত্যেকই নিজেকে রক্ষার স্বার্থে এবং আইন লংঘনকারী কে শাস্তির প্রক্রিয়ায় আনার উপলক্ষে পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে সরকারের হাতে তাদের শাসনাধিকার হস্তান্তর করল। আর চুক্তি প্রদত্ত সরকার তার প্রধান কার্যাদি অর্জন করতে অক্ষম হলে অথবা নির্বাহী সরকার অত্যাচারী হয়ে উঠলে জনগণের অধিকার রয়েছে সেই চুক্তি বাতিল করার। সরল ভাষায় বললে, যখন রাজা বা সরকার জনগণের দেয়া চুক্তি রক্ষা করতে অক্ষম হয় অথবা অত্যাচারী হয়ে উঠে তখন জনগণের অধিকার রয়েছে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার এবং তার সাথে চুক্তি বাতিল করার।
৪
জন লকের সামাজিক চুক্তি এবং তার ব্যক্তিগত অধিকার, বিশেষ করে জীবন ধারণ,স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার থমাস জেফারসন এবং আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনে এক বড় ভূমিকা রেখেছে। থমাস জেফারসন এবং জেমস ম্যাডিসনের কাজে জন লকের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষনীয়। এমন কি আমেরিকার সংবিধান প্রনয়ণে উদারনীতিবাদের জনক জন লকের অবদান সবচেয়ে বেশী এবং সরকারের যে তিনটি বিভাগকে আমরা বর্তমানে দেখি তার আবির্ভাবও জন লকের সামাজিক মতবাদের হাত ধরেই।
পলিকোহলিক থেকে নেয়া লেখাগুলো ডিলেট না করলে প্রব্লেম হতে পারে। তোমার এই সাইট রিপোর্ট করে দিলে আর খুজে পাবে না। লেখা গুলো ডিলেট করে দাও ছোট ভাই
ReplyDeleteসামাজিক চুক্তি সম্পর্কে লকের অভিমত আলোচনা(f.m-15)
ReplyDeleteসামাজিক চুক্তি মতবাদের টমাস হবস,জন লক ও রাইলি রুশোর তুলনামূলক আলোচনা অর্থাৎ তাদের মতবাদের পার্থক্য এটা নিয়ে যদি একটা ব্লক করতেন উপকৃত হতাম।
ReplyDeleteভালো লেখা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজে লাগবে।
ReplyDelete