ম্যাক্স ওয়েবার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব (Max Weber and State Authority)


১.
সামাজিক বিজ্ঞানের প্রায় সকল বিষয়ে ম্যাক্স ওয়েবারের(১৮৬৪-১৯২০) আধিপত্যের ক্ষেত্রটা অত্যন্ত ব্যাপক। সমাজবিজ্ঞানে তো বটেই,রাষ্ট্রবিজ্ঞান,অর্থনীতি কিংবা লোকপ্রশাসনের মতো বিষয়েও তাঁর প্রভাব প্রায় সীমাহীন। The protestant ethics and the rise of capitalism,Economy and Society ,এই বইদুটো হচ্ছে ওয়েবারের ম্যাগনাম ওপাস,যেখানে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর সমাজচিন্তা,ধর্মদর্শন,অর্থবিদ্যা,রাষ্ট্রনীতি এবং আরো নানা বিষয়। এই নিবন্ধে শুধু ওয়েবারের রাষ্ট্র সম্পর্কিত ভাবনাটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত অনুসরন করা হয়েছে তাঁর বহুল আলোচিত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘Politics as a vocation ‘ প্রবন্ধটি। বর্তমান সময়ে তুলনামূলক রাজনীতি পাঠের যে ধারা,বিশেষ করে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান পাঠ করতে গিয়ে বোঝা যায় বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উপর তাঁর প্রভাব কি সুবিশাল। আরো স্পষ্ট করে বললে,ক্ষমতা ও আধিপত্যের ধারণা এবং তা থেকে রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের উথ্থানের যে ব্যাখ্যা ওয়েবার দিয়েছেন,পরবর্তীতে সেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের পদ্ধতিরই আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে।
২.
ওয়েবারের উপর কার্ল মার্কসের প্রভাব প্রশ্নাতীত।বলতে কি একটি সমাজের কাঠামো যে তাঁর উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত,মার্কসের এই ব্যাখ্যা ওয়েবার অস্বীকার করেননি।রাষ্ট্র যে একটি বল প্রয়োগকারী সংস্থা,ওয়েবার এ জায়গাতেও মার্কসের সাথে একমত। কিন্তু তবুও তিনি মার্কসবাদী নন। মার্কস যেখানে বলছেন অর্থনীতিই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল ভিত্তি এবং শুধু উৎপাদন ব্যবস্থাই তৈরি করে সমাজের শ্রেণী কাঠামো, সেখানে ওয়েবার একমত হন নি। সমাজ কাঠামো তৈরিতে অর্থনীতির সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্কও তাঁর কাছে পেয়েছে সমান গুরুত্ব।
মার্কসের কাছে,রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণীর উপর অন্য শ্রেণীর শোষণের হাতিয়ার বা যন্ত্র। কিন্তু ওয়েবার এই আদর্শিক সংজ্ঞাটি মানেন নি। তিনি আধুনিক সমাজের জটিল রাষ্ট্র কাঠামোকে দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত করছেন না;যদিও তিনি মানছেন রাষ্ট্র একটি বল প্রয়োগকারী যন্ত্র। তিনি বলছেন,রাষ্ট্র হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগকারী শক্তি,যার বাস্তব প্রয়োগ ঘটে আমলাতন্ত্রের সাহায্য। অর্থাৎ ওয়েবারের নিকট রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনটি উপাদান। ভূখণ্ড বা নির্দিষ্ট অঞ্চল,একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগকারী শক্তি(monopoly of the means of physical violence) এবং সেই শক্তি প্রয়োগের ‘বৈধতা’(legitimacy).
ওয়েবার বলছেন,শাসকেরা Domination বা আধিপত্যকে জনগণের বৈধতা লাভের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রে তৈরি করে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের। আর রাষ্ট্রে অথরিটি বা কর্তৃত্ব মূলত তিনভাবে তৈরি হয়:ক্যারিসম্যাটিক বা আকর্ষণীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে,সনাতন বা রাজতান্ত্রিক উপায়ে এবং যুক্তিমূলক-আইনগত পদ্ধতিতে যার বাস্তব রূপ হচ্ছে সংসদীয় সরকার।
এই যে বৈধ ক্ষমতা এবং তার প্রয়োগের মাধ্যমে আধিপত্য (Domination) বিস্তার করে শাসন করা বা কর্তৃত্ব লাভ করা,এর জন্যই প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেই যন্ত্রটার যা ব্যতীত আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্র অচল: আমলাতন্ত্র । আর তাই রাষ্ট্রশক্তির মূল ভিত্তি মূলত দুটি। এক হচ্ছে বৈধতা যেটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য এবং দুই হচ্ছে আমলাতন্ত্র যা ব্যতীত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান অচল। আর এই আমলাতন্ত্রও চলে একটা Rationalisation process বা যৌক্তিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে। ওয়েবার রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের গঠন এবং তার উপযোগিতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। এখানে সে আলোচনায় যাবো না।
৩.
প্রথমেই বলেছি,ওয়েবার মার্কসবাদী নন।মার্কস যেখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে যুক্তি বিবর্জিত বলেছেন,ওয়েবার তেমনটা মনে করেন না।তিনি মার্কসের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব ও বস্তুবাদ অস্বীকার করেন নি,তবে রাষ্ট্রে ‘শ্রমিকের একনায়কত্ব’ ধারণায় তাঁর বিশ্বাস ছিলো না। তিনি মনে করেন,উ্ৎপাদন ব্যবস্থা শ্রমিকদের আওতায় আনলেও শেষ পর্যন্ত তা আমলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।ফলশ্রুতিতে তখন শ্রমিকের একনায়কত্বের পরিবর্তে আমলার একনায়কত্বের জয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য হবে। কেননা রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগে যৌক্তিকতা এবং কৌশল অপরিহার্য।
রাষ্ট্র নিয়ে ওয়েবারের মতবাদের সার মূলত এটাই। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা মূলত সমাজবিজ্ঞানের আলোকে রাজনীতির ব্যাখ্যা।তিনি সমাজে প্রথমে ক্ষমতার কাঠামো ব্যাখ্যা করেছেন ।তিনি দেখলেন ক্ষমতা প্রয়োগ করে যে ‘আধিপত্য’ তার বৈধতা লাভের মাধ্যমেই মূলত তৈরি হয় কর্তৃত্ব বা Authority. আর এই রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ধরন মূলত তিন ধরনের এবং ঐতিহাসিকভাবে যা বর্তমানে যুক্তিমূলক-আইনগত পদ্ধতিতে সংসদীয় রাষ্ট্র কাঠামোর রূপ পেয়েছে। আর ওয়েবারের রাষ্ট্রদর্শনের শক্তি মূলত এখানেই। কেননা বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শোষণমূলক হলেও সে চলে একটা যৌক্তিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে; ক্ষমতাকে বৈধ রূপ দিয়ে কর্তৃত্বের মাধ্যমে এবং কর্তৃত্ব তার নিরঙ্কুশ শক্তি প্রয়োগও করে আরেকটা যৌক্তিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে অর্থাৎ আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে।

Comments