ভাববাদী দর্শন ( Idealist Philosophy)


ভাববাদের আরেকটা নাম অধ্যাত্মবাদ।ভাববাদী দর্শনের অসংখ্য শাখা প্রশাখা আছে।এর উপর বইও হাজার হাজার। মূলত দুনিয়ার সব মহান দার্শনিকদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগই ভাববাদী।কিন্তু প্লেটোর ভাববাদের সাথে কান্টের ভাববাদের বিস্তর তফাৎ।আবার বার্কলের ভাবজগতের সাথে হেগেলের বাস্তববাদী ভাববাদেরও অনেক পার্থক্য।তাই ভাববাদী প্রকল্পের বিবর্তন এবং বৈচিত্র্য বহু।

ভাববাদী মূলত কারা? তার আগে একটু বলে নেই ,ভাববাদ আসলে কি?

মানুষ যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছে,তখন থেকেই সে যে সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে সেটা হলো,এই যে সে চিন্তা (thinking) করে এর উৎস কই? সে যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়,নিজের সত্তা(Being) কে অনুভব করে, প্রকৃতি এবং বস্তুজগতে কাজ করে- এ কার দ্বারা হয়? একদল বললো,এটা আসলে শরীর নয়,শরীরের ভেতরে এক অপরিচিত আত্মার বাস যে আসলে আমাদের কর্মের মূল নিয়ন্ত্রক। মৃত্যুর সাথে সাথে আত্মা আমাদের শরীরের ভেতর থেকে বের হয়ে যায় এবং মানুষ চেতনাহীন হয়ে যায়। মূলত শরীর(Body) বাদ দিয়ে আত্মার(soul/spirit) প্রাধান্য স্বীকার করা,এটাই আসলে ভাববাদ। আত্মার স্বীকারোক্তি মানুষকে কল্পনা করতে শেখায় আত্মার অমরত্বের,মৃত্যুর পর আরেকটা জীবনের, ঈশ্বর বা পরমাত্মার। এই হিসেবে ধর্ম বিশ্বাসী (বৌদ্ধ দর্শন ব্যতীত) সকল মানুষই তাই ভাববাদী। 
তাহলে ভাববাদের মূল কথা হচ্ছে Spirit বা আত্মার সার্বজনীনতা। ভাববাদের মতে আত্মা বস্তুর পূর্বগামী এবং বস্তু আত্মার উপর নির্ভরশীল। আত্মার থেকেই মূলত চিন্তা(thought),বুদ্ধি(reason) এবং চেতনা(consciousnesses) প্রভৃতির বহিঃপ্রকাশ।ভাববাদীরা চিন্তাকে উদ্দেশ্য এবং বস্তুকে বিধেয় হিসেবে ধরেই গড়ে তোলেন তাদের দর্শন কাঠামো।
২.
চেতনার মাধ্যমে আমরা বিশ্বজগত সম্পর্কে সচেতন হই। বুদ্ধি এবং চিন্তার বৃত্তিগুলোর মাধ্যমেই অভিজ্ঞতাকে ধারণ করতে পারি। ভাববাদীরা বলেন,চেতনা থেকেই তৈরি হয় বস্তুজগত।বুদ্ধি দিয়েই কেবল বুঝতে হবে প্রকৃতিকে। চিন্তা ব্যতীত বস্তুর অস্তিত্ব সম্ভব নয়।প্রকৃতিজগত চিন্তা-চেতনা এবং বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল। বুদ্ধি যেহেতু চেতন সত্তারই একটা রূপ,এবং চেতন সত্তা নির্ভর করে সার্বিক চেতন-সত্তার উপর,(Universal Consciousness),তাই আমরা যে জগত দেখি তা মূলত ভাবজগতেরই বাহ্যিক রূপ। চিন্তা এবং বুদ্ধির প্রাধান্যের কারনে ভাববাদী দার্শনিকদের বুদ্ধিবাদী বা rationalist বলা হয়।

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক প্লেটোর নিকট বস্তুজগত অধ্যাস ব্যাতীত কিছু নয়। প্রত্যেকটা বস্তুরই প্রকৃত সত্তা (Actual reality) ভাবজগতে বিরাজমান।আমাদের এই পরিবর্তনশীল জগত অসৎ। কেবল আইডিয়ার জগতই সার্বিক এবং পরিবর্তনহীন। তাই আইডিয়ার জগতই সৎ। আরো পরিষ্কার করে বললে যে প্লেটো জগতে বিদ্যমান ছিলেন,তিনি আসলে ভাব জগতে যে প্লেটোর আসল সত্তা বিদ্যমান,তার বিকৃত রূপ!
প্লেটোর এই ভাববাদী দর্শনের প্রভাব পুরো পাশ্চাত্য দর্শনেই ব্যাপক। প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল সার্বিক(Universal) সত্তাকে স্বীকার করেই বস্তুর বিশ্লেষণে নেমেছেন।যদিও তিনি ভাবের আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করেননি।

আসলে ভাববাদী দার্শনিকদের সংখ্যা এতো বিশাল যে তাদের সম্পর্কে এক লাইন করে লিখতে গেলেও লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। তবুও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের নাম বলি। যেমন প্লোটিনাস,একুইনাস,দেকার্ত,লাইবনিজ,স্পিনোজা,বার্কলে,কান্ট,ফিকটে,হেগেল- এরা সবাই পাশ্চত্য দর্শনের এক একজন মহীরূহ দার্শনিক।
মুসলিম দর্শনে ইমাম গাজ্জালী খুবই শক্তিশালী একজন ভাববাদী দার্শনিক। ভারতীয় দর্শনে এই সংখ্যাটা আরো বিশাল ।রামানুজ,শঙ্করাচার্য-এই দুজন এ অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাবশালী অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক।
৩.
ভাববাদীরা আগে থেকেই এক মৌলিক চেতন-সত্তা স্বীকার করে জড় সত্তাকে তার অভিব্যক্তি বলে ধরে নেন(যেমন হেগেল)। কেউ আবার বস্তুকেই অস্বীকার করে শুধু চেতনার প্রাধান্য স্বীকার করেন (যেমন বার্কলে)। অন্যদিকে কান্টের মতো ভাববাদী যিনি বস্তু এবং অভিজ্ঞতার গুরুত্ব স্বীকার করলেও উপসংহার টানেন এই বলে যে বস্তুর আসল রূপ জানা যায় না!

জগতের সমস্ত কিছু এক সর্বব্যাপী চেতন-সত্তা বা ঈশ্বর বা ব্রহ্মে লীন। জগত মায়া,কেবল ব্রহ্মই সত্য-এ হচ্ছে ভারতীয় দর্শনের চরম ভাববাদী প্রকল্প যা প্রধান প্রধান প্রায় সমস্ত ধর্মই স্বীকার করে।
কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের সামনে বিশ্বের যে ইতিহাস তুলে ধরছে,বিবর্তন আমাদের যে গল্প বলছে,সেখানে জড়-ই প্রধান,জড়ের বিকারই প্রাণ এবং তারপর চেতনা-এমনটাই দাবি করেন বস্তুবাদীরা। ভাববাদের বিপরীত গল্প শোনান বস্তুবাদী দার্শনিকেরা। বস্তুবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় অন্য কোন লেখায় দেয়ার ইচ্ছা রইলো।

Comments