জাতীয়তাবাদ (Nationalism) কি এবং কেন?


জাতীয়তাবাদ (Nationalism) নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক একাত্মতার বোধ, রাজনৈতিক চেতনা এবং অনুভূতির ব্যাপার।এই চেতনার সাথে যুক্ত থাকে একটি জাতির বা অনেকগুলো জাতির কিছু সুনির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষা যেমন আলাদা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন,স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন,জাতিগত নিপীড়ন থেকে মুক্তি বা পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি,নিজ জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি কিংবা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরোধিতা ইত্যাদি। যদি এক বাক্য বলতে হয় জাতীয়তাবাদ কি,তাহলে সহজ ভাষায় বলা যায়: একটি অথবা অনেকগুলো জাতি(self-defined ethnic groups) যখন নিজেদের পরাধীনতার শিকলকে চিহ্নিত করে,নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিকে সামনে রেখে,জাতিগত নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য বা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসার জন্য সমস্বার্থবোধে এবং সমচেতনায়(self-identity)জাগ্রত হয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে কোন জাতীয় আন্দোলনে অগ্রসর হয় সে আন্দোলনকেই আমরা জাতীয়তাবাদ বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা যায়।আরো সহজভাবে বললে বলা যায়,কোন একটা জনগোষ্ঠী যদি জাতীয় স্বকীয়তা এবং স্বতন্ত্রভাবে শাসিত হবার দাবি জানায় এবং সেই দাবি যদি আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় তাকেই আমরা জাতীয়তাবাদ বলে অভিহিত করতে পারি(my people should rule,rather than other people-Napoleon)।মোটকথা জাতীয়তাবাদ হচ্ছে প্রতিরোধ,একটি জাতির তার নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য সংগ্রাম।
এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দুটি ভিন্ন দিক আছে যা মূলত দুই ধরনের রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগোয়। এক ধরনের রাষ্ট্রকে বলা হয় জাতীয় রাষ্ট্র যেখানে শুধু একটি জাতি নিজেদের মুক্তির লক্ষ্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পরিশেষে রাষ্ট্র গঠন করে।এক জাতি এক দেশ যেমন প্রাচীন গ্রীক এক জাতি,গ্রীস এক রাষ্ট্র ছিলো কিংবা এখন ফরাসী এক জাতি ফ্রান্স এক রাষ্ট্র । যদিও এই এই বিশ্বায়নের যুগে এই জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা তেমন গ্রহণযোগ্য নয়,তবুও সমস্বার্থ ও ঐক্যবদ্ধতার ব্যাপারটা মাথায় রাখলে এখনো জার্মান,ফরাসি বা বাঙালিরা তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রে প্রধান এবং প্রভাবশালী জাতি যাদের একক নেতৃত্বের মাধ্যমে কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সফল হয়েছে।
আরেক ধরনের রাষ্ট্র (বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা) যাদের আমরা সাধারণত বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করি যেখানে অনেকগুলো জাতি একসাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য সংগ্রাম করে। যেমন ভারত বা ভারতীয় ইউনিয়ন,আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র,ব্রাজিল,রাশিয়া বা রাশিয়ান ফেডারেশন ইত্যাদি। এই বহুজাতিক রাষ্ট্রগুলোও পরাধীনতা এবং সকল প্রকার ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্য একটি নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেয় এবং স্বাধীনতার মাধ্যমে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করে। যেমন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ;ভারতের বিভিন্ন জাতিসমূহ ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল এবং অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্য নিজেদের জাতিগত স্বার্থ ঠিক রেখে একটি নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একত্রিত হয়েছিলো,সেটা হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ(Indian Nationalism)
তাহলে এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।এর সাথে জাতি এবং জাতিসত্তার মূলগত কোন বিরোধ নেই। একটি জাতি অথবা একাধিক জাতি মিলে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে অভিন্ন জাতীয়তায়(Citizenship) আবদ্ধ হতে পারে যেমন বাংলাদেশী জাতীয়তা বা ভারতীয় জাতীয়তা।এটি নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক পরিচিতি;(political identity)জাতিসত্তাগত পরিচিতি নয়।
এবং এ আলোচনা থেকে আরো একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়।সেটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ প্রধানত সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। জাতীয়তাবাদ সামন্তবাদবিরোধী কেননা সে অভ্যন্তরীণ শ্রেণী স্বার্থ বা সামন্ত স্বার্থ সহ্য করে না;সে মুছে ফেলতে চায় সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামি;সে চায় ঐক্য;তার গুরুত্ব ভাষার উপর,সংস্কৃতি রক্ষার উপর এবং অতি অবশ্যই তার লড়াইটা বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার জন্য। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কেননা বিদেশী শক্তির শোষণের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং প্রতিরোধের মাধ্যমেই তার প্রকাশ;আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোতেই তার শক্তি।এখানেই জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীলতা ও গণতান্ত্রিকতা।
গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ ধ্বংস করে দেয় শ্রেণীস্বার্থ;নষ্ট করে দেয় ধর্মান্ধতার ভিত্তি ;দূর্বল করে দেয় রাষ্ট্রের শোষণযন্ত্রটাকে। বর্তমান সময়ে এই জাতীয়তাবাদ এক নৌকায় নিয়ে আসে রাষ্ট্রের সকল জাতিকে;তৈরি করে এক অপূর্ব মেলবন্ধন;যেখানে প্রত্যেক জাতিরই থাকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হবার অধিকার এবং নিজের ভবিষ্যৎ নিরূপণের ক্ষমতা।জাতীয়তাবাদ তৈরি করে গর্ব করার মতো আত্ম-পরিচয় এবং নিয়ে আসে সমষ্টিগত ঐক্যে যেমনটা দেখেছি আমরা ১৯৭১; যে জাতি এক মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে তার জাতীয়তাবাদকে করে তুলেছিলো মহিমান্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ করেছিলো গোটা সমাজকেই।
(জাতীয়তাবাদের এই বিশ্লেষণে কারো আগ্রহ থাকলে পড়তে পারেন শ্রমিকশ্রেণীর মহান রাষ্ট্রনেতা লেনিনের লেখা ‘জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’,যোশেফ স্টালিনের লেখা ‘মার্কসবাদ ও জাতিসমস্যা’এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরির লেখা ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ’ বই তিনটা)

Comments