রাজনীতি (Politics) কি?

এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়,রাজনীতিই এর প্রধান কারন। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতির দ্বারা;রাজনীতিতেই তার প্রধান মাথাব্যথা।আর এই রাজনীতির প্রভাবে বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে তার শাখা বিস্তৃত করতে হয় বিভিন্ন দিকে। কেননা রাজনীতির বিস্তার সর্বস্তরে;অর্থনীতিতে যেমন কঠিন রাজনীতি কাজ করে তেমনি ইতিহাসও নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতির দ্বারাই।এমন কোন সমাজই পাওয়া সম্ভব নয় যেখানে রাজনীতি কাজ করে না; এমনকি সাহিত্যও রাজনীতি নিরপেক্ষ নয় মোটেই।রাজনীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে বেচারা আজ আর নিজের কূল-কিনারাই খুঁজে পাচ্ছে;লৈঙ্গিক রাজনীতি(gender politics) বা আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি(identity politics)-ও আজ তার প্রধান মাথাব্যথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামক দৈত্যকে ধরতে গেলে আগে বুঝে ওঠা চাই,রাজনীতি কি বস্তু? এর উৎপত্তি কখন হয়?
২.
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল তাঁর ‘পলিটিকস’ বইয়ের এক জায়গায় বলেন,রাজনীতি হচ্ছে সামাজিক অস্তিত্বের পূর্ব শর্ত [Politics as the essence of social existence].আসলে এরিস্টটল বোঝাচ্ছেন,আমরা যখন দুই বা ততোধিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাই বস্তুত তখনই আমরা একটি রাজনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। এই রাজনৈতিক সম্পর্কটাই প্রাকৃতিক কেননা,এরিস্টটল বলেন,(১)মানুষ সবসময়ই সমাজে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করতে চায় (২) নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় এবং তার জন্য সমাজের স্বল্প সম্পদের সঠিক বণ্টনের অংশ চায় (৩)ব্যক্তি অন্যকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে সদা সচেষ্ট।
একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবো,এরিস্টটলের এই তিনটা যুক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের রাজনৈতিক প্রাণী হয়ে ওঠার কারন। যে কারনে তাকে বলতেই হয়, All people are politicians,but some are more political than others.
পরবর্তীতে দেখবো রাজনীতির সংজ্ঞায়নে যে রাজনীতি তা মূলত এরিস্টটল কেন্দ্রিকই;যদিও তা দুই ভাগে বিভক্ত। একদলকে বলা Traditionalist বা ঐতিহ্যবাদী আর অন্য দলকে বলা হয় Empirical বা অভিজ্ঞতাবাদী।
৩.
আমরা এখন বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতির সংজ্ঞা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ঐতিহ্যবাদী রাষ্ট্রচিন্তকেরা সাধারনত রাজনীতিকে রাষ্ট্র সরকার ও আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রেখেছেন।এ চিন্তার অনুসারীদের মতে,রাজনীতি অপরিহার্যরূপে রাষ্ট্র নামক বাস্তবতার চতুর্দিকে ঘোরে। এ চিন্তাধারার ইতিহাসই দীর্ঘ; প্লেটো থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তক হ্যারল্ড লাস্কি,সকলেই এই ঐতিহ্যবাদী আদর্শমূলক(Normative) রাজনীতিতে আবর্তন করেছেন। প্লেটো বলেন,’রাজনীতি হচ্ছে আত্মার পরিচর্যার কৌশল’ আর তাই রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনেতার (philosopher-King) দায়িত্ব হচ্ছে রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর রাষ্ট্রের নাগরিকের মধ্যে নৈতিক গুণাবলির প্রসার ঘটানো। অন্যদিকে সেন্ট টমাস একুইনাসও রাজনীতিকে নৈতিক দিক হিসেবে কাজে লাগানোর কথা বলেন। তিনি বলেন রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রে এমন একটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করা যেখানে সবাই একসাথে মিলে নৈতিক ও সৎ পথে জীবন-যাপন করতে পারে।[Politics means to unify different parts of community for which a community is gathered is to live a virtuous life]. রাজনীতির এই কল্যাণমূলক ধারণা অবশ্য পরিবর্তন হলো আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়াভেলির হাতে। তিনি বললেন,রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রনেতার উদ্দেশ্যেকে বাস্তবায়িত করার পন্থা,এজন্য যদি তাকে অসৎ পন্থা দিয়েও যেতে হয় তবুও করার কিছু নাই। শক্তির রাজনীতির এই ধারা অনুসরন করেই হবস বললেন,রাজনীতি হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তার সন্ধান। [politics as the pursuit of peace and security].
৪.
তবে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাজনীতির খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটা সংজ্ঞা দেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার। তিনি বলেন, রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অথবা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে ক্ষমতার অংশ লাভের চেষ্টা অথবা ক্ষমতার বিতরণকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা। ওয়েবারের সংজ্ঞায় এই গোষ্ঠীর (group) প্রতি গুরুত্ব দানই তৈরি করলো রাষ্ট্র বিমুখ রাজনীতির পথ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এবার আদর্শবাদী ধারা থেকে মুখ ফেরালেন অভিজ্ঞতাবাদের দিকে অর্থাৎ রাজনীতির Empirical পাঠের দিকে। আর্থার বেন্টলি ঘোষণা করলেন,রাজনীতির কাঁচামাল রাষ্ট্র থেকে উৎসারিত হয় না,বরং সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের কার্যাবলি ও সম্পর্কসমূহই এদের যোগান দেয়।আর গ্রাহাম ওয়ালেস রাজনীতিকে পাঠ করলেন মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে।তিনি বললেন,মানবীয় আচরনের জটিল জালের মধ্যেই রাজনীতির আবর্তন।
অভিজ্ঞতাবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমেই আচরণবাদী রাজনীতির শুরু। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি রাষ্ট্র নির্দেশিত না হয়ে সমাজ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় [A movement which insists on analyzing only the observable behavior of political actors].
তাই প্রখ্যাত আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাসওয়েলের মতে,রাজনীতি হচ্ছে প্রভাব ও প্রভাবশালীদের পাঠ। আরেকজন প্রখ্যাত আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হচ্ছেন ডেভিড ইস্টন।তিনি তার সিস্টেম তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তৈরি করেন তাঁর রাজনীতির সংজ্ঞা। তিনি বলেন,রাজনীতি হলো এক ধরনের কর্মকাণ্ড,যা একটি সমাজের জন্য সুবিধাসমূহের কর্তৃত্ববাদী বরাদ্দের সাথে জড়িত। ইস্টনের এই সংজ্ঞাটাকে আরো পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্য করেছেন উইলিয়াম ভূলম।তিনি বলেন,রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা ব্যবহারের সাথে জড়িত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহযোগিতার দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যা একটি গোষ্ঠীর জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
রাজনীতির এরূপ সংজ্ঞায়নের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাজনীতিকে সমাজের প্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা।যেমন ডেভিড ট্রুম্যান বলেন,রাজনীতি হলো সমাজের স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের কার্যাবলি এবং তাদের ভেতরকার দ্বন্দ্বসমূহের সামঞ্জস্য বিধায়ক প্রক্রিয়া।
তবে আচরণবাদী রাজনীতির সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়ন করেন মেয়ারসন ও ব্যানফিল্ড তাদের Politics,Planning and the public interest বইতে।তাদের মতে,রাজনীতি হচ্ছে একটি কর্মকাণ্ড(চুক্তির পূর্বে আলোচনা,যুক্তিতর্ক,মিটিং,মিছিল,শক্তি প্রয়োগ,প্ররোচনা,প্রোপাগাণ্ডা প্রভৃতি) যা দিয়ে একটি ইস্যুর উপর আন্দোলন হয় এবং তার নিস্পত্তি হয়।উদাহরণ হিসেবে আমরা আমাদের কোটা বিরোধী আন্দোলনের কথা বলতে পারি যা খুব সহজভাবেই এই সংজ্ঞার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।
৫.
রাজনীতির ধারণা কখনো স্থবির নয় বরং অত্যন্ত গতিশীল,এখানে কোন সুনির্দিষ্ট মতানৈক্য নাই।কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট বিষয় অবশ্যই রাজনীতির মূল মাথাব্যথার কারন। যেমন ওয়েবার বলেন বল প্রয়োগই রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অন্যদিকে আচরনবাদীদের প্রেক্ষিতে,সামাজিক বৈচিত্র্য ও দ্বন্দ্ব নিরসনেই রাজনীতির প্রধান দায়িত্ব।*
এই আলোচনা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়(যদি আমরা ঐতিহ্যবাদী এবং আচরনবাদী দুই দৃষ্টিকোণের সমন্বয় থেকে দেখি),রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় মূলত তিনটি:এক. রাষ্ট্র,সরকার এবং জনগণ;দুই.ক্ষমতার ব্যবহার;তিন.মানব সমাজের ভেতরকার দ্বন্দ্ব এবং তার নিরসন।
এই বিষয়গুলো মাথায় থাকলেই বোঝা যাবে রাজনীতির উৎপত্তি তখনই হয় যখন তৈরি হয় ভিন্নমত,পণ্যের বণ্টনে সমস্যা,প্রশ্ন চলে আসে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে,চেষ্টা করা হয় কোন সুবিধা আদায়ের কিংবা মীমাংসার চেষ্টা করা হয় সমাজ থেকে সৃষ্ট কোন দ্বন্দ্বের।যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে রাজনীতি ব্যাখ্যা করতে চাওয়া হয় তখনই আসলে বোঝা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নে কেন সমাজবিজ্ঞান বা অর্থনীতিসহ সামাজিক বিজ্ঞানের আরো অনেকগুলো শাখা-প্রশাখার দিকে হাত বাড়াতে হয়।
[*Politics involves disagreements and the reconciliation of those disagreements,and therefore can occur at any level- Alan Ball 
এই বিষয়ে কেউ পড়তে চাইলে নিচের তিনটা বই পড়তে পারেন;বিশেষ করে এলান বলের বইটা।
1.Alan R.Ball, Modern Politics and Government 
2.Bernard Crick, In defense of Politics 
3.Kenneth Minogue, Politics:A Very Short Introduction.]

Comments