সার্বভৌমত্ব ( Soverignity) A to Z


রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তা হলো “সার্বভৌমত্ব” বা “Sovereignty”। সার্বভৌমত্ব কী, কেন, কাদের জন্য, কীভাবে আসে, এর স্থায়িত্ব কেমন ইত্যাদি আরও অনেক কিছু- এ ধারণা গুলো অনেকের কাছেই কিছুটা অস্পষ্ট আর গোলমেলে। এমনকি অনেকেই আমরা আছি যারা ‘সার্বভৌমত্ব কেবল রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়োজনীয় উপকরণ’ এর বাইরে এর কোনো তথ্য বলতে পারব না। তাহলে এই সার্বভৌমত্ব কী? গতানুগতিক উত্তর হল রাষ্ট্র গঠনের চারটি উপাদানের একটি, যা ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হয় না। অথচ এর বাইরেও সার্বভৌমত্ব নিয়ে অনেক তথ্য আছে যা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা।
সার্বভৌমত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে অনেক দার্শনিক, অধ্যাপক নানান মতবাদ দেন। আমেরিকার খ্যাতিমান অধ্যাপক Burgess বলেন, “It is the original absolute unlimited universal power over the individual subjects and all association of subjects.” Willoughby বলেছেন, “Sovereignty is the supreme will of the state.” জার্মান দার্শনিক George Hegel বলেন, “Nothing against the state, nothing outside the state.” অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে লঙ্ঘন করতে পারে এমন কিছুই নেই। সার্বভৌমত্বের এসকল সংজ্ঞাই বলে দেয়, এটি একটি রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা।


লাতিন শব্দ Superanus থেকে উৎপন্ন হ‌ওয়া শব্দ ‘Sovereignty’ এর অর্থ হল সর্বোচ্চ বা সর্বশ্রেষ্ঠ। সার্বভৌমত্ব তাহলে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ করে তোলে, কিন্তু কার থেকে? উপরের সংজ্ঞা থেকেই আমরা বলতে পারি, অন্য সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে। আমরা জানি রাষ্ট্র একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এটি সর্বাধিক ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতাই হল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌম এ শব্দগুলো প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৫ শতকের দিকে ফ্রেঞ্চ আইনজীবীদের দ্বারা, পরবর্তীতে ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান রাজনৈতিক শব্দ হিসেবে যুক্ত হয়। 
তাহলে তো বলাই যায় সার্বভৌমত্ব শব্দটি নতুন, মাত্র ৫০০ বছর ধরে চেনা। আসলে এর পুঁথিগত ব্যবহার নতুন হলেও এর ধারণা কিন্তু বেশ প্রাচীন। গ্রীক দার্শনিক Aristotle, Plato প্রমুখ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা বা আইনের সবোর্চ্চ প্রয়োগের কথা বলেছেন। এছাড়া অনেক রোমান আইনজ্ঞগণ রাষ্ট্রের পূর্ণ অধিকার প্রয়োগের জন্য মত প্রকাশ করেছিলেন, যাকে বলা যেতে পারে সার্বভৌম ক্ষমতা। তবে মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রে সার্বভৌম অঞ্চলের উদাহরণ দেখা যায়নি যেহেতু সেসময়টা নানান অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কুসংস্কারে ভরপুর ছিল। ফলে জাগতিক দিক সেসময় প্রাধান্য পায়নি। 
সার্বভৌমত্ব নামে আধুনিক যুগে সর্বপ্রথম সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রদান করেন ফরাসি দার্শনিক Jean Bodin তাঁর ‘The Republic (1576)’ ব‌ইটিতে। রোমান ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্বে ভাঙনের শংকায় থাকা ফরাসি দেশের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে Bodin রাজাকে নাগরিকদের ওপর তাঁর সর্বোচ্চ আইন প্রণয়ন করতে বলেন। তিনিই প্রথম সার্বভৌম শক্তিকে অসীম, অবিভাজ্য ও চিরস্থায়ী বলেছেন- তবে এক্ষেত্রে সার্বভৌম শক্তি রাষ্ট্রের মৌলিক বিধান, নৈতিক অনুশাসন এবং অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করতে বাধ্য থাকবে। ১৬২৫ সালে হল্যান্ড এর আইনবিদ Hugo Grotius সার্বভৌমত্বের মতবাদকে সুন্দর ও স্বচ্ছ করে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন প্রত্যেক রাষ্ট্র‌ই সমান, স্বাধীন এবং নিজ অঞ্চলে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। আরো বলেন, সেই শক্তিই সার্বভৌম যার কোন কাজ অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কিংবা নাকচ করতে পারে না বা ইচ্ছা প্রয়োগের অবকাশ রাখে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তিনিই প্রথম স্পষ্ট করে বলেন।
রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর বিচিত্র আচরণের আলোচনা ও মতামতের পর থেকে দেখা যায় সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যতটা প্রবল, রাষ্ট্রের বাইরেও এক‌ইরকম সবল। এ থেকে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় ; একটি হল অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব এবং অপরটি বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব মানে প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কতিপয় ব্যক্তিদের আনুগত্য, আদেশ প্রয়োগ করার চূড়ান্ত আইনি কর্তৃত্ব। এ কর্তৃত্ব থাকে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ও সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর। রাষ্ট্রের এ ক্ষমতা কার্যকর করা হয় সরকারের নানা কাজের মাধ্যমে। বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বুঝতে Hugo এর তত্ত্বটিই যথেষ্ট। একটি রাষ্ট্রের উপর অন্য কোনো রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো স্বেচ্ছাচারিতা না করতে পারাই বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব। তবে অনেক সময় দেখা যায় যে কোনো রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব কিছুটা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পূর্ণ সার্বভৌম শক্তির কিছুটা লোপ পায়।
রাষ্ট্রের কোথায় সার্বভৌমত্ব অবস্থান করে তা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। রাজতন্ত্রের শাসনতন্ত্রে সার্বভৌমত্বের অবস্থান নির্ণয় করা সহজ কেননা সেখানে রাজাই সর্বশক্তিমান। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থায় কোথায় সেই চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকে তা বলা মুশকিল। ব্রিটিশ দার্শনিক Austin একবার বলেছেন পার্লামেন্টে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত আর একবার বলেছেন নির্বাচকমণ্ডলীর উপর ন্যস্ত। যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ এ দেখা যায় প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাশালী হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের জন্য তাঁর কংগ্রেসের সমর্থন ও অনুমোদন দরকার হয়। এছাড়া আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট আইনত শাসনতন্ত্রের অভিভাবক। তাহলে এদের মধ্যে সার্বভৌম কে? অনেকের মতে আবার সংবিধান সকল শক্তির আধার। কিন্তু এ সংবিধান কেবল একটি দলিল এবং প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল। সুতরাং কীভাবে বলা যাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কোথায়? এ প্রসঙ্গে Willoughby বলেন, ‘Whatever the government authority that is exercised, whether legislative, executive or judicial in character sovereignty is manifested.’ অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের লক্ষণ, সরকারের বা শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য নয়। এটি বরং মানুষের প্রাণ স্বরূপ। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ মানুষ আছে। প্রাণকে যেমন দেহের কোন অংশে খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং দেহের সর্বত্র বিরাজমান তেমনি সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রকাঠামোর সবখানে উপস্থিত থেকে রাষ্ট্রকে প্রাণবন্ত রাখে।
এখন আসা যাক রাষ্ট্রের ক্ষমতার গুণাগুণ নিয়ে। আইনগতভাবে পাওয়া সংজ্ঞা ও উদাহরণ থেকে বলা যায় সার্বভৌম শক্তির যে গুণাবলী থাকতেই হবে তা হলো-

১. স্থায়িত্ব

সার্বভৌমত্বের প্রথম বৈশিষ্ট্য। এটি চিরন্তন, অনাদি এবং চিরস্থায়ী। অর্থাৎ, রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরু থেকে সার্বভৌমত্ব ছিল এবং রাষ্ট্রের পুনর্বিন্যাস, সরকারের অবসান, পরিবর্তন এর পরেও সার্বভৌমত্বের স্থায়িত্ব নিশ্চিত। তবে কোনো রাষ্ট্র কখনো সার্বভৌমত্ব হারালে রাষ্ট্রের অবসান ঘটবে।

২. সর্বব্যাপকতা

রাষ্ট্রের ভেতর প্রত্যেক নরনারী, এবং তাদের সংগঠিত প্রত্যেক সমাজ, সম্প্রদায়, সংঘ এর সার্বভৌম শক্তির অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য। স্থলসীমান্ত ছাড়াও সমুদ্র, রাষ্ট্রীয় সীমানার আকাশে পর্যন্ত এই ক্ষমতার ব্যাপকতা উপলব্ধি করতে হয়। সুতরাং রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি বাধা বন্ধনহীন ও নিরঙ্কুশ।

৩. অবিভাজ্যতা

সার্বভৌমত্বকে কেউ বিভক্ত বা বণ্টন করতে পারে না। এটি একক শক্তির অধিকারী। এই চূড়ান্ত ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রের কেন্দ্রেই ন্যস্ত থাকে। অধ্যাপক Calhoun বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব পূর্ণ একটি ব্যাপার। একে ধ্বংস না করে বিভাজন করা যায় না। যেমন আমরা অর্ধ চতুর্ভুজ বা অর্ধ ত্রিভুজ বলতে পারি না, তেমনি অর্ধ সার্বভৌম ক্ষমতার কথাও বলতে পারি না।’


৪. মৌলিকতা, চরম ও সীমাহীনতা

রাষ্ট্রের কেউ সার্বভৌম ক্ষমতার সমান বা ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। সার্বভৌমত্ব যদি অন্য কোনো শক্তির দ্বারা সীমিত হয়ে যায়, তবে সেই অন্যশক্তিটিই সার্বভৌমত্ব বলে পরিগণিত হবে। আইনগতভাবে অসীম এ ক্ষমতার ব্যবহার সর্বত্র হতে পারে। আইন এর থেকেই উৎসারিত।

৫. হস্তান্তরের অযোগ্যতা

সার্বভৌমত্ব কারো দখলে ছেড়ে দেয়া যায় না। মানুষ যেমন নিজের প্রাণ অন্যকে দান করতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারে না। কেননা একে ছেড়ে দেয়ার মাঝেই এর বিলুপ্তি।
বৈশিষ্ট্য থেকে সার্বভৌম শক্তিকে অসীম মনে হলেও অনেক পণ্ডিতজন একে সীমিত বলেছেন। এমনকি সার্বভৌমত্ব এর প্রথম সার্থক মতবাদ দানকারী Bodin ও একে তিন প্রকার রেখা দিয়ে সীমাবদ্ধ করেছেন। তাঁর মতে সার্বভৌমত্ব-
  1. অন্য রাষ্ট্রের সাথে সন্ধির দ্বারা
  2. প্রজাদের সাথে চুক্তির দ্বারা
  3. মৌলিক বিধানের দ্বারা সীমিত।
কেউ কেউ একে ধর্ম বা ঈশ্বরের বিধান এবং নৈতিক অনুশাসন দিয়ে খর্বীকৃত করেছেন। কিন্তু সমালোচনার আলোকে দেখলে জানা যায় যে, সার্বভৌম ক্ষমতা কখনো কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। এটি চূড়ান্ত শক্তি। জনগণের অধিকার, সংবিধান, আইনসভা, আন্তর্জাতিক আইন, কোনো কিছু দিয়েই রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা সীমিত হয় না। রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় অনেকগুলি অনুশাসন এবং বিধান মেনে চলে মাত্র।
এত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সার্বভৌমত্বের রূপেও রয়েছে ভিন্নতা ; যেমন,

১. Titular and Real sovereignty বা নামমাত্র ও প্রকৃত সার্বভৌমত্ব

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা অথবা সম্রাটকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করা হতো, তবে বর্তমানে সেই অর্থে রাণী ২য় এলিজাবেথকে ইংল্যান্ড এর নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলা হলেও তা নামেমাত্র। বাস্তবে তাঁকে চরম ক্ষমতার অধিকারী বলা যায় না, কারণ পার্লামেন্টের হাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে এখানে রাণীকে নামমাত্র ও পার্লামেন্টকে প্রকৃত সার্বভৌম বলা যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যার নামে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় সে নামেমাত্র আর যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে প্রকৃত সার্বভৌম। ১৯৭২ এ বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্রপ্রধান এমনি নামেমাত্র সার্বভৌম ছিলেন।

২. Legal sovereignty বা আইনগত সার্বভৌমত্ব

আইনগত সার্বভৌম বলতে সেই সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত আদেশ বা নির্দেশ আইনের আকারে প্রকাশিত হয় এবং উক্ত আইন দেশের বিভিন্ন বিচারালয়ে স্বীকৃত হয়ে কার্যকর হয়। আইন অনুসারে সে কর্তৃপক্ষ ঐশ্বরিক আইন, নীতি শাস্ত্রের বিধান এবং জনমতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পারে। যেমন, ইংল্যান্ডের রাণীসহ পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে। কথিত আছে, The English parliament can do anything except making a man a woman and a woman a man (Walter Bagehot)
তবে বাস্তব পরিস্থিতি আসলে তা নয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহে এ আইনগত সার্বভৌমের পেছনে অত্যন্ত অস্পষ্ট হলেও আর এক সার্বভৌম শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হয়, যার নাম রাজনৈতিক সার্বভৌম।

৩. Political sovereignty বা রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব

এটি একটি অস্পষ্ট ও অনির্ণীত শব্দ। এ সার্বভৌম খুঁজে পাওয়া যাবে জনমতে, গণভোটে। অর্থাৎ ভোটদান, বিভিন্ন সংবাদপত্রের অভিমত, বক্তৃতা মঞ্চ, বিভিন্ন জনের অভিমত, বুদ্ধিমান ব্যক্তিবর্গের কথাবার্তা এবং আরও অনেক কিছুর মাঝে রাজনৈতিক সার্বভৌম খুঁজে পাওয়া যাবে। এথেকে বুঝতে পারছি আইনগত সার্বভৌম এর চেয়ে রাজনৈতিক সার্বভৌম কম স্পষ্ট। তবে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ইচ্ছার বাইরে আইনগত সার্বভৌমত্ব প্রভাব ফেলতে পারে না কিন্তু আবার আইনগত সার্বভৌমত্বের উপর রাজনৈতিক সার্বভৌমের কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণ নেই। এজন্য বলা যায়, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হলেও এই দিক দুটি আসলে অভিন্ন ও একে অপরের পরিপূরক। মনীষী Diecy বলেন, ‘আইনজ্ঞ যে সার্বভৌমকে স্বীকার করেন, যার পেছনে এমন এক সার্বভৌম আছে যার পদতলে আইনগত সার্বভৌম লুটিয়ে পড়তে বাধ্য।’ বলা বাহুল্য যে এখানে আর কিছু নয়, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে আইনগত সার্বভৌম এবং রাজনৈতিক সার্বভৌম কার্যক্ষেত্রে এক হয়ে যাক। পরোক্ষ গণতন্ত্রে আইনকে পূর্ণ ভাবে কার্যকর করতে হলে এবং জনকল্যাণে নিয়োজিত হতে হলে আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌম একসাথে মিলে মিশে চলতে হবে।

৪. Popular sovereignty বা জনগণের সার্বভৌমত্ব

এ সার্বভৌমত্বের প্রাথমিক ধারণা বেশ পুরোনো। রোমান আইনজ্ঞ হয়ে পরে মধ্যযুগে এ ধারণাটি প্রাধান্য পায়। স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের অত্যাচারে মধ্যযুগের অবসান ঘটিয়ে Marailio of Padua এবং William of Ockham জনমুক্তির জন্য ঘোষণা করেন, জনগণ‌ই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তাঁরা চুক্তিবাদের মধ্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে রাজা কেবল রাষ্ট্রের কাজের জন্য বিদ্যমান। মুসলিম দর্শন, ফরাসি দর্শন, এমনকি আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণায় ও জনগণের সার্বভৌমত্বকে মূলধন করা হয়েছিল যে, জনগণ‌‌ই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক ও ক্ষমতাশালী। তবে এই মতবাদটি বেশ উৎসাহ ও আবেগতাড়িত।

৫. De Facto and De Jure sovereignty বা বাস্তব এবং আইনসঙ্গত সার্বভৌমত্ব

যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আইনের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে বা অন্য উপায়ে যুদ্ধ ও বিপ্লবের সময় নিজেদের ইচ্ছামত সবকিছু পরিচালনা করতে পারে, সেই অবস্থাকে বাস্তব বা De Facto সার্বভৌমত্ব বলা হয়। এধরনের সার্বভৌম ক্ষমতার আইনগত যথার্থতা কম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, Mussolini’s Black Shirts March এর কথা (১৯২২)। সেসময় আইনসভা De Jure বা আইনসঙ্গত ছিল এবং Mussolini আইনসম্মত ভাবেই ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু পার্লামেন্টের ক্ষমতা হাতে রেখেই দেশ পরিচালনা করেছেন। এভাবে তিনি আইনগত সার্বভৌম ব্যবহার করে বাস্তব সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছেন। যেমনটি করেছিলেন Hitler। তাহলে বাস্তব ও আইনসঙ্গত সার্বভৌমের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে এবং কোনো কারণে যখন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে আইনত যে সার্বভৌম থাকেন, কার্যত সে সার্বভৌম নাও থাকতে পারে (Mussolini’s Parliament)
সার্বভৌমত্বের মতবাদকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ। একত্ববাদের তত্ত্বটি Austin তাঁর ‘Lecture on Jurisprudence(১৮৩২)’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন এবং একত্ববাদকে  Gierke, Maitland, Barker, Laski, MacIver প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কঠোর সমালোচনা করেন। যাকে বহুত্ববাদ নামে অভিহিত করা হয়। বহুত্ববাদীগণ তিন দিক থেকে একত্ববাদকে আক্রমণ করেন। তাঁদের মতানুসারে সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব অপ্রয়োজনীয়, অবাস্তব, ভ্রান্ত এবং ভয়ংকর। তাঁরা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে একটি ‘সম্মানীয় কুসংস্কার’ (Venerable Superstition) আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন এই কুসংস্কার সামাজিক জীবন থেকে যত দ্রুত দূর হয় তত ভালো। Laski বলেছেন, ‘It will be of lasting benefit to political science if the whole concept of sovereignty was surrendered.’ বহুত্ববাদী গণ বলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করা বর্তমানে বিপজ্জনক। কেননা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার যুগে সার্বভৌম ক্ষমতার অহংকারের চেয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের আবেদন অধিক কাম্য। বহুবাদে সার্বভৌমত্বকে মানবের আশাআকাঙ্ক্ষা পূরণের পরিপন্থি ও বলা হয়। তাঁরা বলেন ক্ষমতায় কেবল রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার না রেখে ধর্ম সম্প্রদায়, আর্থিক সংঘ, পরিবার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে যথেষ্ট পরিমাণ স্বতন্ত্র কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দেয়া জরুরি।
তবে বহুত্ববাদী গণ যত‌ই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মৌলিক গুরুত্ব নাকচ করুক না কেন, সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের সুষ্ঠু বিকাশ ও আন্তর্জাতিকতার সঠিক প্রকাশের জন্য‌ও রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অপরিসীম। এখানেই বহুত্ববাদের ভুল প্রকাশিত হয়। তবে তাঁদের এ নীতিভিত্তিক আলোচনা নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমৃদ্ধি সাধন করেছে বহুগুণে।

Comments

  1. ধন্যবাদ,সেই সাথে শুভকামনা, ব্লগটি খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete

Post a Comment